শেয়ার
করুন

ওয়েবসাইটি শেয়ার করুন

বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার জনক মাইকেল মধুসূদন দত্ত

May 20

বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার জনক মাইকেল মধুসূদন দত্ত

মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪–১৮৭৩) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী চরিত্র। তিনি বাংলা কাব্যে ইউরোপীয় ধারার প্রবর্তক হিসেবে খ্যাত, যাঁর হাত ধরে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূচনা ঘটে। ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি, বর্তমান বাংলাদেশের যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন রাজনারায়ণ দত্ত, যিনি পেশায় একজন আইনজীবী এবং শিক্ষিত ব্যক্তি। মধুসূদনের মা জাহ্নবী দেবী ছিলেন ধর্মপরায়ণা।

কৈশোর থেকেই মধুসূদন ছিলেন বিদ্রোহী মনোভাবের অধিকারী এবং ইউরোপীয় শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট। তিনি কলকাতার হিন্দু কলেজে শিক্ষা গ্রহণ করেন, যেখানে ইংরেজি সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর আগ্রহ জন্ম নেয়। পরবর্তীতে ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং নাম নেন “মাইকেল”, যা তাঁর জীবন ও সাহিত্যে এক বিরাট মোড় এনে দেয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে তিনি পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, কিন্তু নিজের আদর্শচ্যুতি ঘটাননি।

সাহিত্যজীবনের শুরুতে তিনি ইংরেজি ভাষায় কবিতা লিখতেন, তবে শীঘ্রই বুঝতে পারেন, মাতৃভাষাই হতে পারে তাঁর চিন্তার প্রকৃত বাহক। বাংলা ভাষায় ফিরে এসে তিনি সাহিত্যজগতে এক নতুন যুগের সূচনা করেন। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাব্য “মেঘনাদবধ কাব্য”, যা ১৮৬১ সালে প্রকাশিত হয়। এটি একটি খন্ডকাব্য, যেখানে রামায়ণের খলনায়ক ইন্দ্রজিৎ (মেঘনাদ) কে নায়ক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এই কাব্য Milton-এর Paradise Lost দ্বারা প্রভাবিত, এবং বাংলা সাহিত্যে এর তুলনা প্রায় নেই।

তিনি বাংলা ভাষায় সনেট প্রবর্তনের কৃতিত্বও অর্জন করেন। ইউরোপীয় রীতি অনুসরণ করে তিনি ১৪ পঙক্তির সনেট রচনা শুরু করেন, যা বাংলা কাব্যরীতিতে এক অভিনব সংযোজন। তাঁর অন্যান্য বিখ্যাত রচনার মধ্যে রয়েছে তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, বীরাঙ্গনা কাব্য, একেই কি বলে সভ্যতা, ও নাটক কৃপণকথা। “বীরাঙ্গনা কাব্য” বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, কারণ এটি নারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত পত্রাকারের কাব্য, যা নারীর অধিকার ও অনুভূতিকে তুলে ধরেছে।

মধুসূদনের ব্যক্তিজীবন ছিল সংগ্রাম ও বেদনায় ভরপুর। তিনি জীবনের শেষদিকে চরম দারিদ্র্য ও ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েন। ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন কলকাতার আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।

তাঁর সাহিত্যকর্ম ও জীবনদর্শন বাংলা সাহিত্যকে এক নতুন মাত্রা দেয়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত কেবল একজন কবি বা নাট্যকার ছিলেন না—তিনি ছিলেন একজন সংস্কারক, এক বিদ্রোহী রোমান্টিক, যিনি বাংলা ভাষার গদ্য ও কাব্যে ইউরোপীয় চিন্তা ও ছন্দের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে সাহিত্যকে বিশ্বদরবারে স্থান দেওয়ার ভিত্তি গড়ে দেন। আজও তিনি বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার অন্যতম প্রধান পথিকৃৎ হিসেবে স্মরণীয়।